প্রচলিত আছে, পাপ বাপকেও ছাড়ে না। ক্ষমতার পালাবদলে এবার কাড়ি কাড়ি অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র সাঈদ খোকনের বিরেুদ্ধে।
ডিএসসিসির মেয়র হিসেবে ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস দায়িত্বে এসেই অবৈধ দোকান উচ্ছেদ অভিযান চালাচ্ছেন। উচ্ছেদ অভিযান চলাকালে ব্যবসায়ীদের বাধা এলেও পিছু হটেনি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। এরমধ্যেই উচ্ছেদের কবলে পড়া ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে বেরিয়ে আসতে শুরু করে সাবেক মেয়র সাঈদ খোকনের অনিয়মের পাহাড়। তবে বর্তমান মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস আশ্বাস দিয়েছেন, যারা প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত তাদেরকে অবশ্যই পুনর্বাসন করা হবে।
এদিকে ভুক্তভোগীরা বলছেন, রক্ষক হয়েই ভক্ষকের ভূমিকা পালন করেছেন সাবেক মেয়র সাঈদ খোকন। যাকে বলা হতো ‘নগর পিতা’, অথচ তিনিই মেয়রের চেয়ারে বসে নগর লুটপাটে ক্ষমতার অপব্যবহার করেছিলেন।
কেবল তিনি একা নন, তার সঙ্গে ছিল সিটি করপোরেশনের কতিপয় কমকর্তা-কর্মচারী এবং একটি বৃহৎ মার্কেটের কমিটিসহ স্থানীয় কতিপয় প্রভাবশালীরা। তারা মিলেমিশে হাতিয়ে নিয়েছেন শত শত কোটি টাকা। তারই একটি জ্বলন্ত উদাহরণ, গুলিস্তানে ফুলবাড়িয়া মার্কেট-২ এর ৯১১ টি অবৈধ দোকানকে অর্থের বিনিময়ে বৈধতা প্রদান। প্রত্যেকটি দোকান থেকে নূন্যতম ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা, এমনকি কোনো কোনো দোকান থেকে ৩৪ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন সাঈদ খোকন ও তার সহযোগীরা। অনিয়ম ধরা পড়ার আশঙ্কায় কৌশল হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে ছাদ্মবেশী নানান রূপ। এক্ষেত্রে কতিপয় বিশ্বস্ত লোকদের ব্যবহার করেছেন তিনি।
ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, এমন করে তিনি ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা প্রায় ৭০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এদিকে নিজের দায় এড়াতে কেবল সাঈদ খোকনের ঘাড়ে দায় দিতে একাধিক প্রমাণ হাতে রেখেছেন মার্কেটের সভাপতি দেলোয়ার হোসেন দেলু। তবে, এই দেলু যে দুধে ধোয়া তুলশি পাতা! তা নিয়ে সংশয়ের কথা জানিয়েছেন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী।
দেলোয়ার হোসেন দেলুর বিরুদ্ধেও অভিযোগ রয়েছে, মার্কেট থেকে টাকা কালেকশনের সিংহভাগ বিভিন্ন ব্যাংক চেক, পে অর্ডার এবং নগদ টাকা সাঈদ খোকন ও তার সহযোগীদের প্রদান করলেও ওইসবের একটি অংশ নিজেই রেখে দিতেন। ‘শাহনেওয়াজ এন্টারপ্রাইজ, মেঘনা এডিবল অয়েল রিফাইনারি লিমিটেড, বসুন্ধরা মাল্টি ফুড প্রোডাক্টস্ লিমিটেডসহ আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের নামের ব্যাংক একাউন্টের মাধ্যমে এই টাকা সাবেক মেয়র পর্যন্ত পৌঁছে দিতেন দেলোয়ার। যে বিষয়ে দেলোয়ার নিজেই আরটিভির কাছে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন।
দেলোয়ারের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সাঈদ খোকনদের টাকা দেওয়ার প্রমাণ রাখতে দেলোয়ার উত্তরা ব্যাংকের ফুলবাড়িয়া ব্রাঞ্চ, এক্সিম ব্যাংকের পল্টন ব্রাঞ্চ, যমুনা ব্যাংক, সাউথইস্ট ব্যাংকের করপোরেট ব্রাঞ্চের একাউন্ট ব্যবহার করেছেন। এসব ব্যাংকের ৪৮টি চেক ট্রানজেকশনের লিস্ট পাওয়া গেছে তার কাছে। এছাড়াও রয়েছে কোটি কোটি টাকা প্রদানের পে অর্ডারসহ নগদ টাকা দেওয়ার একাধিক প্রমাণ। শত শত কোটি টাকার অনিয়মের এই ফিরিস্তি আরটিভি’র হাতেই রয়েছে।
সাঈদ খোকন ২০১৫ সালের মাঝামাঝি দিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছিলেন। দায়িত্ব নেওয়ার পর বিভিন্ন সময়ে মুখে মুখে স্বচ্ছতার বুলি আওড়ালেও কয়েক মাসের মাথায় তিনি লুটপাটের কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। প্রমাণ বলছে, ২০১৫ সালের জুলাই থেকেই তিনি ফুলবাড়িয়া মার্কেট থেকে ‘শাহনেওয়াজ এন্টারপ্রাইজ’ নামক ব্যাংক একাউন্টের মাধ্যমে টাকা হাতিয়ে নেওয়া শুরু করেন। জুলাই মাসের ৫ তারিখে ওই একাউন্টে ২০ লাখ টাকা জমা হয়। ২০১৮ সালের ৪ ডিসেম্বর উত্তরা ব্যাংকের ফুলবাড়িয়া ব্রাঞ্চের দেলোয়ার হোসেন দেলুর একাউন্ট থেকে ১ কোটি টাকা মেঘনা এডিবল অয়েলস রিফাইনারি লিমিটেড টাকা উত্তোলন করে। এমন করেই ধাপে ধাপে ২০১৫ থেকে ২০১৯ সালের বিভিন্ন সময়ে নিয়ম বহির্ভূত শত শত কোটি টাকার লেনদেনের ঘটনা ঘটে।
সাবেক মেয়র সাঈদ খোকনের বক্তব্য:
এই অবৈধ লেনদেনের বিষয়ে সাবেক মেয়র সাঈদ খোকন আরটিভি নিউজকে বলেন, আসলে আমি ব্যক্তিগতভাবে কোন টাকা পয়সা হাতিয়ে নেইনি। যে টাকা নেওয়া হয়েছে তা সিটি করপোরেশনের দায়িত্বরত মেয়রের তহবিলে নেওয়া হয়েছে, যা সরকারের তহবিলেই জমা পড়েছে। সিটি করপোরেশন মেয়রের তহবিল একাউন্টসে যদি এখনও তল্লাসী করা হয়, ওই টাকার অস্তিত্ব পাওয়া যাবে। আমাদের সিটি করপোরেশন কিভাবে এবং কোন প্রসেসে ওইসব দোকানের ভাড়াগুলো আদায় করেছিল তার প্রমাণ আমার কাছে রয়েছে। টাকা নেওয়ার সিদ্ধান্ত আমার একার নয়, তা ছিল বোর্ড সভার সিদ্ধান্ত। যা হাইকোর্টের নির্দেশনা এবং আইনজীবীদের মতামত নিয়ে নেওয়া হয়েছিল। প্রকৌশলী দিয়ে দোকানগুলোর নকশা কারেকশন করে সেগুলোর বৈধতা দেওয়া হয়েছিল। সেখানে গত ৮-৯ বছরের ভাড়া আদায় করা এবং রশিদ দেওয়া, হলফনামা রিসিভ করা সবই লিগ্যাল ছিল। ৯১১ টি দোকান থেকে আমরা সিটি করপোরেশন যে পরিপ্রেক্ষিতে ভাড়া আদায় করেছিলাম, তা আদালতের নির্দেশেই বোর্ড সভা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। টাকাগুলো আমার ব্যক্তিগত একাউন্টে নেইনি।
তিনি আরও বলেন, দেলোয়ার হোসেন দেলু কোন একাউন্টে, কার একাউন্টে, কি টাকা জমা দিয়েছেন এটা আমার জানা নেই। আমরা সিটি করপোরেশনের একাউন্টে টাকা নিয়েছি। শাহনেওয়াজ এন্টারপ্রাইজ নামের আমার কোনও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নেই এবং এই নামের আমার কোনো একাউন্টও নেই, এক কথায় এই নামে আমার কোনও কিছুই নেই। বরং তাকে (দেলোয়ার হোসেন দেলুকে) আইনের আওতায় এনে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হোক। এটি সম্পূর্ণ ভূয়া তথ্য, আমাকে রাজনৈতিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য এসব কাজ করা হচ্ছে।
মার্কেট সভাপতি দেলোয়ার হোসেন দেলুর বক্তব্য:
মার্কেট সভাপতি দেলোয়ার হোসেন দেলু আরটিভি নিউজকে বলেন, ফুলবাড়িয়া মার্কেট থেকে সাঈদ খোকন শত কোটি টাকার ঘুষ বাণিজ্য করেছেন। তার প্রতিনিধি হিসেবে সিটি করপোরেশনের ইউসুফ আলী সরদার ঘুষের টাকার জন্য আমার নারায়নগঞ্জ বাসায় যায় এবং সাঈদ খোকনের সাথে আমাকে ফোনে ধরিয়ে দেয়। তারপরও আমি টাকা দেইনি। তবে মার্কেটের ব্যবসায়ীরা মেয়রের কাছে সরাসরি টাকা পাঠিয়েছে। ইউসুফ আলীর হাতেও ২ কোটি টাকা দিয়ে এসেছিল মার্কেটের ব্যবসায়ীরা। ফুলবাড়িয়ার ওই তিনটি মার্কেট ছাড়া সিটি করপোরেশনের একটি মার্কেটও বাদ নেই যে সাঈদ খোকনের মাধ্যমে জর্জরিত হয়নি। তার আশকারায় বাইরের লোকজন মার্কেটে প্রথমে টিন দিয়ে দোকান বানায়, পরে সেগুলো দেয়াল দিয়ে দখল করে। একটা তিল পরিমাণ জায়গা খালি রাখেনি। যারা অবৈধভাবে দখল করছিল তাদের আমি বলেছি, ঘুষের টাকা কেউ ফেরত দেয় না। এই টাকা আর ফেরত পাওয়া যাবে না। তোমরা এতোগুলো টাকা দিয়ে কেনো অস্থায়ী জায়গায় বসতেছো। ‘শাহনেওয়াজ এন্টারপ্রাইজ’ নামের ব্যাংক একাউন্টের মাধ্যমে সাঈদ খোকন টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এ কাজে সাঈদ খোকন আমাকে চাপ প্রয়োগ করে ব্যবহার করেছে।